Odhikar

বখাটেপনা ও নারীর পরিস্থিতি

taskin_nd_27-11-16বাংলাদেশের ইতিহাসে বখাটেদের দ্বারা নিপীড়ন এবং যৌন হয়রানি আজকের ঘটনা নয়। এর বিরুদ্ধে জোরালোভাবে সমন্বিত সামাজিক আন্দোলন ও প্রতিরোধ গড়ে না ওঠায় বর্তমান পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। গত কয়েক বছরে বখাটেদের আক্রমণে অনেক মেয়েই খুন হয়েছেন- আত্মহত্যা করেছেন, এসিড সন্ত্রাস, যৌন হয়রানি, আহত ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। বখাটেরা অনেক মেয়েদের এসিড মারা, ধর্ষণ, অপহরণ, লাঞ্ছিত করার ভয় দেখিয়েছে, আর এসব ঘটনার প্রতিবাদ করায় অনেক মেয়ের মা-বাবা-ভাই বা আত্মীয় স্বজনকে বখাটে ও এদের সাঙ্গপাঙ্গরা মারধর, অঙ্গহানি করা এমনকি খুন করেছে।
গত ৩ নভেম্বর মানিকগঞ্জে বিলাল হোসেন (৪৫) নামে একজন দশম শ্রেণীর ছাত্রীর বাবাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, জনৈক এখলাস মাতবরের বখাটে ছেলে সুমন (২২) মেয়েটিকে দীর্ঘ দিন ধরে রাস্তাঘাটে উত্ত্যক্ত করত। সুমনের ভয়ে মেয়েটি স্কুলে যেতে ভয় পেত। মেয়েটির পরিবারের পক্ষ থেকে সুমনের পরিবারে নালিশ করা হলে তারা উল্টো মেয়েটির পরিবারকে হুমকি দেয়। পরবর্তীকালে সুমনের পরিবার মেয়েটির সাথে সুমনের বিয়ের প্রস্তাব দেয়। বিয়ে না দিলে সুমন সে মেয়েকে কিডনাপ করবে ও কেউ বাধা দিলে তাকে মেরে ফেলবে- এই বলেও হুমকি দেয়। কিন্তু বখাটের সাথে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে বিয়ে না দেয়ায় সুমন ও তার সহযোগীরা মেয়েটির বাবা বিলাল হোসেনকে হত্যা করে বলে মেয়েটির পরিবার অভিযোগ করে।
যেসব বখাটে প্রভাবশালী বা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পায়, তারা আরো বেপরোয়া। যেমন সিলেটে দীর্ঘ দিন ধরে খাদিজাকে ছাত্রলীগ নেতা বদরুল উত্ত্যক্ত করে আসছিল, এমনকি ২০১২ সালে উত্ত্যক্ত করার সময় গণপিটুনির শিকার হলেও রাজনৈতিক রঙ ছড়িয়ে উত্ত্যক্তের কথা গোপন করে পার পেয়ে যায়। গত ৩ অক্টোবর খাদিজাকে কোপানোর ভয়াবহ দৃশ্য অনলাইনে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে বদরুলকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে। যদি শুরুতেই খাদিজাকে উত্ত্যক্ত করার কারণে বদরুলের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হতো, তবে হয়তো খাদিজার জীবনে এমন ভয়াবহ সময় আসত না।
তেমনি আরেকটি ঘটনা- ঝিনাইদহের শাহানুর বিশ্বাস তার মেয়েকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় গত ১৬ অক্টোবর শাহানুরের ওপর হামলা চালায় স্থানীয় ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও মেম্বার কামাল হোসেন ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী। তাদের হামলার ফলে শাহানুর দুই পা হারান। অপরের জমিতে কাজ করা পাঁচ সদস্যের সংসার চালানো শাহানুর পঙ্গু অবস্থায় কিভাবে সংসার চালাবেন, তা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় আছেন। এ মামলায় উচ্চ আদালত আসামিদের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের আদেশ দিলে গত ২৩ নভেম্বর মামলার প্রধান আসামি কামাল হোসেনসহ ১৩ জন আদালতে আত্মসমর্পণ করলে আদালত তাদের কারাগারে পাঠান।
তবে চিন্তার কথা হলো- অনেক ক্ষেত্রেই জামিনে এরা বের হয়ে আসে এবং ভিকটিম ও ভিকটিম পরিবারের সদস্যদের ভয়ভীতি দেখায় বলে অভিযোগ আছে। বখাটেদের হয়রানির কারণে অনেক মেয়ের শিক্ষাজীবন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, অনেক মা-বাবা এদের হাত থেকে মেয়েকে রক্ষার জন্য তড়িঘড়ি করে অল্প বয়সেই বিয়ে দিচ্ছেন। ফলে বাল্যবিয়ের শিকার হওয়া মেয়েরা এক ধরনের নিপীড়ন থেকে বাঁচতে গিয়ে অন্য ধরনের বৈষম্য ও সহিংসতার শিকার হচ্ছে। এ মেয়েরা এক দিকে যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ছে। অন্য দিকে তারা পারিবারিক সহিংসতার শিকার হচ্ছে বা এর ঝুঁকিতে রয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন অধিকার সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায়, ১ জানুয়ারি ২০১০ থেকে ৩১ অক্টোবর ২০১৬ পর্যন্ত উত্ত্যক্ত করা ও যৌন হয়রানির কারণে ১১৪ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন। এ ছাড়া ৩৪ জন নিহত, ৩০৬ জন লাঞ্ছনার শিকার এবং ৫৪ জন নারী অপহৃত হয়েছেন। বখাটের নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় উত্ত্যক্তের শিকার হওয়া কিছু মেয়ের মা-বাবা-ভাই বা আত্মীয়, এমন ২৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বখাটেদের কোনো বিচার হয়নি। আবার দু-একটি ক্ষেত্রে যদিও বিচার হয়েছে, শেষ পর্যন্ত শাস্তি হয়নি। ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার চাঁপা রানী ভৌমিকের কথা মনে আছে? ২০১০ সালের ২৬ অক্টোবর বখাটে দেবাশীষ সাহা রনি তাকে মোটরসাইকেল চাপা দিয়ে মেরে ফেলে। চাঁপা রানী ভৌমিকের মেয়েকে দেবাশীষ উত্ত্যক্ত করত এবং তিনি এর প্রতিবাদ করায় সে এই কাণ্ড ঘটায়। এ ঘটনার প্রায় চার বছর পর ২০১৪ সালের ৯ জুন মামলার প্রধান আসামী দেবাশীষকে (২৬) মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন ফরিদপুরের জেলা ও দায়রা জজ আদালত। ২০১০ সালে চাঁপা রানীকে হত্যার পাঁচ দিন পর দেবাশীষকে গ্রেফতার করা সম্ভব হলেও ২০১২ সালের ৮ জুলাই হাইকোর্ট থেকে জামিন নেয়ার পর থেকে সে পলাতক রয়েছে। চাঁপা রানীর মেয়েটি এ রায়ের পর বলেন, ‘এ রায়ে আমি সন্তুষ্ট। কিন্তু আসামি দেবাশীষ পলাতক। তাই রায় কার্যকর হবে কি না, তা নিয়ে মনে সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি, এ রায় কার্যকর হলে দেশে উত্ত্যক্তকারীদের বিরুদ্ধে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে।’ (প্রথম আলো, ১০ জুন ২০১৪)। কিন্তু এর পর দেবাশীষকে গ্রেফতার করাও যায়নি, তাই কোনো দৃষ্টান্তও স্থাপিত হয়নি।
২০১১ সালে ইভটিজিংকে (উত্ত্যক্ত) যৌন হয়রানি হিসেবে বিবেচনা করে আইনে অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দেন বিচারপতি মো: ইমান আলী ও বিচারপতি শেখ হাসান আরিফের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। রায়ে বলা হয়, ইভটিজিং শব্দটি অপরাধের মাত্রা হালকা করে দেয়, এর পরিবর্তে সর্বস্তরে যৌন হয়রানি শব্দটি ব্যবহার করতে হবে। ক্রমাগত ইভটিজিং ও এর ফলে বেশ কিছু মেয়েকে হত্যা ও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটলে ইভটিজিং প্রতিরোধে নির্দেশনা চেয়ে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির পক্ষে করা এক রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে আদালত এ রায় দেন। এ ধরনের নির্যাতন ও হয়রানি প্রতিরোধে তদারকি করতে প্রতি থানায় সেল গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়। ওই কমিটিকে প্রতি মাসে একবার জেলা উন্নয়ন কমিটিতে এ সম্পর্কিত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়। একই সাথে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি ও সাক্ষীর নিরাপত্তা বিধানে সরকারকে আইন প্রণয়নের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মুঠোফোন (এসএমএস), এমএমএস, ই-মেইল ও ফোন-মোবাইলের মাধ্যমে উত্ত্যক্ত করাকেও অপরাধ হিসেবে গণ্য করে- এ বিষয়গুলোও আইনে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ সংক্রান্ত হাইকোর্টের বেশির ভাগ নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়নি।
বখাটেদের কারণে কিশোরী-তরুণীদের হত্যা-আত্মহত্যার পরিসংখ্যান কিছুটা পাওয়া গেলেও ক্রমাগত হুমকি-লাঞ্ছনার ফলে সৃষ্ট ভীতি ও অসহায়ত্ব কিশোরী-তরুণীদের যে মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতি করছে, এর কোনো পরিসংখ্যান নেই। ক্রমাগত হুমকির সম্মুখীন হতে থাকলে মানুষের মনোবল ভেঙে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। বখাটের দৌরাত্ম্যের কারণে নাজেহাল নারীদের অনেকেই সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়নে পিছিয়ে পড়েছেন।
অপরাধীর বিচার না হলে নতুন নতুন অপরাধী সৃষ্টি হয়। সমাজে হতাশা আর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। অপরাধীদের বিচার করে শাস্তি নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। তাই যৌন হয়রানি বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা খুব প্রয়োজন। বখাটেদের দমনে বিচ্ছিন্ন নয়, বরং সমাজে সমন্বিত সচেতনতামূলক ও দায়িত্বশীল কার্যক্রম চালু করা উচিত। বখাটে হয়ে কেউ জন্ম নেয় না। তাই সমাজে যেসব কারণের জন্য একজন বখাটে হয়ে ওঠে- সেগুলোকে রোধ করা প্রয়োজন। তৃষা, ইলোরা, নিতু, রিশাসহ বখাটেদের অত্যাচারে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া আরো অনেক কিশোরী- তরুণীদের মতো আর যেন কেউ চলে না যায়, সে জন্য সবাইকে চেষ্টা করতে হবে।

*তাসকিন ফাহ্‌মিনা মানবাধিকার সংস্থা অধিকার- এর সঙ্গে সম্পৃক্ত জেন্ডার বিশেষজ্ঞ; email- taskin133@gmail.com

এই লেখাটি ২৭ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে www.dailynayadiganta.com এ প্রকাশিত হয়েছে

Subscribe

Subscribe to our e-mail newsletter to receive updates.